ফুটবল খেলার জন্ম ইতিহাস বিস্তারিত

 ফুটবল খেলার জন্ম ইতিহাস

তোমরা অনেকেই জানো যে, ফুটবল হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি লেখা। অন্যান্য খেলার তুলনায় এর প্রতি মানুষের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। বিশ্বকাপ, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ছাড়াও প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ও স্যাটেলাইটের যুগে অজপাড়াগাঁয়ে বসেও ফুটবলপ্রেমীরা ফুটবল খেলা দেখার সুযোগ পায়। আর বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। অথচ আমরা অনেকেই জানি না ফুটবল খেলার ইতিহাস সম্পর্কে। সংক্ষেপে আজ তোমাদের জানাব ফুটবল খেলার ইতিহাস সম্পর্কে।
ফুটবল বা সকার খেলার একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ডে ফুটবল তার বর্তমান রূপে উদ্ভূত হয়। কিন্তু গেমটির বিকল্প সংস্করণ অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল এবং তা ফুটবল ইতিহাসের একটি অংশ।



বল নিয়ে প্রথম পরিচিত দলগত খেলার প্রচলন তিন হাজার বছর আগের পুরোনো, যা মেসোআমেরিকান সংস্কৃতিতে ঘটেছিল। খেলাটি অ্যাজটেকদের দ্বারা প্রবর্তিত, যা Tchatali নামে পরিচিত ছিল, যদিও এ খেলার বিভিন্ন সংস্করণ সেই সময় বৃহৎ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। অ্যাজটেক জনগণ হলো মধ্য মেক্সিকোর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে সেসব গোষ্ঠী, যারা নাহুয়াটল ভাষায় কথা বলতেন। কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এ খেলার বলটি সূর্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো এবং হেরে যাওয়া দলের অধিনায়ককে দেবতাদের কাছে বলি দেওয়া হতো। রাবার দিয়ে তৈরি বাউন্সিং বল ছিল মেসোআমেরিকান বল গেম সংস্করণগুলোর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা অন্য কোনো প্রাথমিক সংস্কৃতিতে প্রচলিত ছিল না।

লাথি মারার সঙ্গে জড়িত প্রথম পরিচিত বল খেলা খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনে প্রচলিত ছিল, যা কুজু (cuju) নামে পরিচিত ছিল। কুজু খেলাটি একটি বর্গাকৃতি মাঠে গোলাকার একটি বল (সেলাই করা চামড়ার ভেতরে পশম বা পালক দিয়ে তৈরি) দিয়ে খেলা হতো। এই খেলার একটি পরিবর্তিত রূপ পরে জাপানে ছড়িয়ে পড়ে, যা কেমারি (kemari) নামে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুশীলন করা হতো।



সম্ভবত আরও পুরোনো কুজু খেলা, যা মার্ন গুক (Marn Gook) নামে পরিচিত। ১৮০০-এর দশকে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের মতে, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের দ্বারা এটি প্রাথমিকভাবে লাথি মারার সঙ্গে জড়িত একটি বলের খেলা ছিল। বলটি পাতা বা শিকড় দ্বারা তৈরি করা হতো। নিয়মগুলো বেশির ভাগই অজানা, তবে গেমের অন্যান্য প্রাথমিক সংস্করণগুলোর মতোই এ খেলায় বলটিকে শূন্যের ওপরে ধরে রাখাটাই ছিল সম্ভবত এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীন গ্রিস থেকে বল খেলার অন্যান্য বৈচিত্র্য জানা যায়। সেই সময় বলগুলো চুলে ভরা চামড়ার টুকরো দিয়ে তৈরি করা হতো। নথি অনুযায়ী, প্রথম বাতাসে ভরা বলের প্রচলন সপ্তম শতাব্দীর। বল গেমগুলো অবশ্য নিম্নস্তরের খেলা ছিল এবং প্যানহেলেনিক গেমসে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। প্রাচীন রোমে, বল গেম বড় আখড়াগুলোতে (অ্যাম্ফিথিয়েটার) বিনোদনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবে হার্পাস্টাম নামে সামরিক অনুশীলনে এটি প্রচলিত ছিল। এটি ছিল রোমান সংস্কৃতি, যা ফুটবলকে ব্রিটিশ দ্বীপে নিয়ে আসে। তবে, ব্রিটিশ জনগণ কোন মাত্রায় এই বৈচিত্র্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং কোন মাত্রায় তারা তাদের নিজস্ব রূপগুলো তৈরি করেছিল, তা অনিশ্চিত।

সর্বাধিক স্বীকৃত তথ্যানুযায়ী, গেমটি ১২ শতকে ইংল্যান্ডে বিকশিত হয়েছিল। এই শতাব্দীতে, ফুটবলসদৃশ খেলা ইংল্যান্ডের তৃণভূমি ও রাস্তাগুলোতে খেলা হতো। লাথি ছাড়াও খেলায় মুষ্টি দিয়ে বল ঘুষিও জড়িত ছিল। ফুটবলের এই প্রাথমিক রূপটি খেলার আধুনিক পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি রুক্ষ এবং হিংসাত্মক ছিল।


বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ধারনা করা যায় ফুটবল খেলা প্রথম শুরু করেছিল গ্রিক এবং রোমান সম্প্রদায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকে। প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানরা বল দিয়ে বিভিন্ন রকমের খেলা খেলত, তার মধ্যে কিছু কিছু খেলা পা ব্যবহার করে খেলত। রোমান খেলা Harpastum এসেছে গ্রিক খেলা Episkyros থেকে যা গ্রিক নাট্যকার  Antiphanes (388–311 BC) এবং পরে ক্রিস্টিয়ান দার্শনিক Clement of Alexandria (c.150-c.215 AD) তাদের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই খেলাটা রাগবি ফুটবল খেলার মত ছিল। রোমান রাজনীতিবিদ Cicero (106–43 BC) বর্ণনা করেছেন ঐ খেলার সময় একজন মানুষ নাপিতের দোকানে সেভ হওয়ার সময় বলের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন। ঐ বল গুলো বাতাস দ্বারা পূর্ণ থাকত অনেকটা বেলুনের মত।

ফিফার তথ্য অনুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক খেলা cuju ই হল  ফুটবল খেলার সর্বপ্রথম রুপ যার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। যদিও ফিফা প্রাচীন গ্রিক খেলা Episkyros কে ফুটবল খেলার সর্বপ্রথম রুপ হিসেবে আগে স্বীকৃতি দিয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিলিটারিরা অনুশীলন হিসেবে এটা খেলত। ঐতিহাসিক চাইনিজ মিলিটারি গ্রন্থ Zhan Guo Ce যা প্রণীত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে ১ম শতাব্দীর মধ্যে যা তে ফুটবল কথাটি খুঁজে পাওয়া যায়। এতে মিলিটারিদের একটা অনুশীলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে যা cuju নামে পরিচিত(cuju মানে kick ball) আর এটা খেলার জন্য একটা চামড়ার বল প্রয়োজন ছিল যাকে পা দিয়ে লাথি মারা হত এবং সিল্কের কাপর দিয়ে ছোট হোল তৈরি করা থাকত মাটি থেকে ৯ মিটার উপরে বাশের সাথে। চীনের হ্যান সাম্রাজ্যের সময় (206 BC–220 AD), cuju  খেলার নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরবর্তীতে এই খেলার বিভিন্ন রুপ জাপানে এবং কোরিয়াতে বিস্তার লাভ করে, জাপানে এই খেলা  kemari  এবং কোরিয়াতে chuk-guk নামে পরিচিত। পরে আরেক ধরনের গোলপোস্ট বানানো হয় যা মাঠের মাঝখানে বসানো থাকত। অশোকা সাম্রাজ্যের সময় জাপানে kemari খেলা বিকাশ লাভ করে।kemari খেলার নিয়ম ছিল কয়েক জন মানুষ একটা বৃত্তাকার মাঠের ভিতর বল লাথি দিয়ে খেলবে তবে তারা চেষ্টা করত বল যেন মাটিতে ড্রপ না পড়ে বা যেন শূনে ভেসে থাকে।

তবে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে বল খেলা বিভিন্ন দেশে মানুষেরা খেলত। যেমন ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ অনুসন্ধানকারী John Davis গ্রিনল্যান্ডের Inuit দের সাথে ফুটবল খেলেছিল। ১৬১০ সালে আমেরিকানদের খেলা লিপিবদ্ধ করেছিলেন  William Strachey নামের একজন ঔপনিবেশিক। তবে অস্ট্রেলিয়ায় লাথি মেরে বল খেলা শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান উপজাতিরা যা বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যায়। নিউজিল্যান্ডে Māori রা প্রথম বল খেলা শুরু করে যার নাম ছিল Ki-o-rahi এবং এই খেলার নিয়ম ছিল একটা বৃত্তাকার মাঠকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একটা করে দল থাকত এবং প্রত্যেক দলে ৭ জন করে খেলোয়াড় থাকত এবং মাঠের মাঝখানে একটা বৃত্তাকার সীমানা থাকত। দুই ভাবে এই খেলার পয়েন্ট নির্ধারিত হত তা হল একদন আরেক দলের সীমানা পার করে দিতে পারলে এবং মাঝের বৃত্তটা স্পর্শ করতে পারলে বল দিয়ে। ইউরোপে তথা ইংল্যান্ডে বল খেলা শুরু হয়েছিল ৯ম শতাব্দীতে যা Historia Brittonum বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম দিকে যে বল খেলা হত তার নাম ছিল “mob football” এবং যা খেলা হত মূলত প্রতিবেশী শহরগুলোর মধ্যে এবং ইহা খেলা হত বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনে। এই খেলায় দুই দলে অগণিত খেলোয়াড় থাকত এবং এরা একটা বলকে গায়ের জোরে ধাক্কা ধাক্কি করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে পারলে পয়েন্ট হত।

আয়ারল্যান্ডে ১৩০৮ সালে ফুটবল খেলা হয়েছিল যা John McCrocan নামের একজন দর্শক খেলাটা দেখেছিল যা তার বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির  Florence শহরে যে বল খেলা হত তার নাম ছিল “calcio storico” এবং পরবর্তীতে এই “calcio storico” ই হল আধুনিক ফুটবলের প্রাথমিক রুপ।

এই খেলায় সর্বচ্চ ২৭ জন খেলোয়াড় থাকত এবং প্রত্যেক দলে বিভিন্ন সংখ্যার খেলোয়াড় থাকত যেমন কোন দলে ১৫ জন আবার কোন দলে ২০ জন এবং গোলরক্ষক থাকত ৫ জন। কিন্তু এই নিয়ম বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে তাই পরবর্তীতে ১৮৭০ সালে আইন করা হয় যে প্রত্যেক দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকতে হবে এবং এর মধ্য থেকে একজন গোলরক্ষক থাকবে একটি দলে। তাই ১৮৭০ সাল থেকেই আধুনিক ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়। অনেক গবেষণা করে দেখা যায় যে ১০+১০=২০ জন খেলোয়াড়ই যথেষ্ট পুরো মাঠটা কভার করতে। তাই এই ১১+১১=২২ জনের  নিয়ম করা হয়।

১৯২৮ সালে সর্বপ্রথম আর্সেনালের পরিচালক পর্ষদ সহজে চেনার জন্য খেলোয়াড়দের জার্সিতে নাম্বা্র বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। তখন স্বাগতিক দলের জার্সি নাম্বার থাকত ১-১১ পর্যন্ত এবং সফরকারী দলের নাম্বার থাকত ১২-২২ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৪০ সালে সিদ্ধান্ত হয় যে একই নাম্বার বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রাও নিতে পারবে কিন্তু নাম্বার ঐ ১-২২ পর্যন্ত থাকতে হবে। ১৯৯৩ সালে সর্বপ্রথম জার্সিতে খেলোয়াড়ের নাম লেখা হয় এবং যেকোন নাম্বার খেলোয়াড় নিতে পারবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপর থেকেই মুলত ফুটবল বাধা মুক্ত হয়।

⚽ আধুনিক ফুটবলের উৎপত্তি:
ইংল্যান্ডে আধুনিক ফুটবলের সূচনা:
আধুনিক ফুটবলের জন্মস্থান হিসেবে ইংল্যান্ডকে ধরা হয়।

১৯শ শতকের আগে ইংল্যান্ডে বিভিন্ন স্কুলে ও অঞ্চলে বিভিন্ন নিয়মে বল খেলা হতো।

একেক জায়গায় একেক রকম নিয়মে খেলা হতো – কিছু জায়গায় হাত দিয়ে খেলা চলত, কিছু জায়গায় কেবল পা ব্যবহার করা হতো।

১৮৬৩ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত:
২৬ অক্টোবর ১৮৬৩ সালে, লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় "দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন" (FA)।

এই সংগঠনই আধুনিক ফুটবলের নিয়ম-কানুন তৈরি করে।

একই বছর ফুটবল এবং রাগবির মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হয়। রাগবি ও ফুটবল আলাদা দুটি খেলা হিসেবে পরিচিতি পায়।

⚽ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবল:
FIFA-এর প্রতিষ্ঠা:
১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় FIFA (Fédération Internationale de Football Association), ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা।

FIFA ফুটবলকে একটি বিশ্বমানের খেলায় পরিণত করে।

প্রথম বিশ্বকাপ:
১৯৩০ সালে উরুগুয়ে-তে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম FIFA বিশ্বকাপ।

উরুগুয়েই প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হয়।

⚽ ফুটবলের জনপ্রিয়তা:
ফুটবল বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে খেলা হয়।

প্রতি ৪ বছরে একবার অনুষ্ঠিত FIFA World Cup পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরগুলোর একটি।

ক্লাব পর্যায়ে UEFA Champions League, English Premier League, La Liga, Serie A ইত্যাদি লিগগুলো বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি দর্শকের মন জয় করে চলেছে।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url